সৈয়দ শামসুল হকের রক্তগোলাপ
ফজলুল হক সৈকত : সৈয়দ শামসুল হকের বিপুল রচনাসম্ভার বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ অধ্যায়। বর্তমান আলোচনা তার একটি উপন্যাস রক্তগোলাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
‘স্বপ্ন, বাস্তব, মায়া, বিভ্রম, বস্তু’র সীমারেখাবিষয়ক ধারণা আর মানসিক বিভ্রান্তির বিবরণ এই রক্তগোলাপ। উপন্যাসটির রচনা, ঘটনা-বিন্যাস এবং বিষয় উপস্থাপন-কৌশল সম্বন্ধে লেখক জানাচ্ছেন- “মনে পড়ছে, রক্তগোলাপ লিখেছিলাম এক রেস্তারাঁয় বসে- সকাল থেকে একটানে প্রায় মধ্যরাত অবধি। আজকাল লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে যাদুবাস্তবতা বলে একটি ধারা শনাক্ত করা হয়।
পেছনের দিকে তাকিয়ে যখন রক্তগোলাপ লেখাটি দেখি, তখন আবিষ্কার করে বিস্মিত হই, ঘটনা-বিন্যাস ও কল্পনার ‘যাদু’ আমি সেই ১৯৬৩ সালেই ব্যবহার করেছিলাম, তবে, এই যাদু নির্মাণের সূত্রটি কিন্তু পেয়েছিলাম আমাদেরই রূপকথা ও ময়মনসিংহ গীতিকা থেকে।… বাংলা সাহিত্যে এই যাদুবাস্তবতার নির্মাণ ছিল বহুশত বছর পূর্ব থেকেই।”
প্রসন্নতা, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য, প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতা, মানসিক স্থিরতা আর নির্ভয় ও নির্ভরতার প্রায়-অচিন্ত্যনীয় এক প্রেক্ষাপট নির্মিতি পেয়েছে রক্তগোলাপের কাহিনী বয়নযাত্রার সূচনালগ্নে।
উপন্যাসটির আরম্ভ এরকম- ‘বছরের এ সময়ে বৃষ্টি হয় কেউ কখনও শোনেনি। এ হচ্ছে এমন একটা সময়, যখন আকাশটা প্রজাপতির পাখার মতো ফিনফিন করতে থাকে রোদ্দুরে, নীল রঙে; যখন উত্তর থেকে নতুন প্রেমের মতো গা-শির-শির-করা মিষ্টি বাতাস বয় কী বয় না তা বোঝাও যায় না; যখন লোকেরা খুব স্ফূর্তির মেজাজে থাকে আর বলাবলি করে- সংসারে বেঁচে থাকাটা কিছু মন্দ নয়;’ বৃষ্টির কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও নেহায়েত কম নয়- জিনিসপত্র ভিজেছে প্রচুর, নৌকাডুবিতে মারা গেছে তেরোজন, ভেঙে পড়েছে মসজিদের ছাদ, ডুবেছে রেললাইন, ভেসে গেছে হাটের দোকানের সব মালামাল। এই অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির দায় গিয়ে পড়ে ম্যাজিশিয়ান নাজিম পাশার ওপর।
এলাকাবাসীর ধারণা জাদুর বলে পাশা এ কাজ করেছে। অশিক্ষিত এই জনপদের মানুষদের এমন সন্দেহও স্বাভাবিক মনে হয়। অবশ্য এ সন্দেহ আর অভিযোগ বাতাসে মিলিয়ে যায় অভ্যাগত ‘নতুন ম্যাজিশিয়ান’-এর প্রচেষ্টায়। তার সহজ যুক্তি বৃষ্টি নামিয়ে, স্বাভাবিক জীবনযাপন বিনষ্ট করে, শো-এ অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে নাজিম পাশার কোনো লাভ নেই, ক্ষতি ছাড়া।
প্রফেসর জেসি দত্তর সাগরেদ মোহাম্মদ নাজিমুদ্দিন ভূঁইয়া বারো বছর আগে ম্যাজিক শোয়ের দল গঠন করে। এই দলে আরও আছে তার কন্যা চম্পা, অন্যতম সহযোগী জহির, ব্যান্ডপার্টির চারমূর্তি- খাড়ানাক, বোঁচানাক, পটকা আর চালকুমড়ো, আছে ছোট সাগরেদ সামাদ আর অভ্যাগত আল্লারাখা ওরফে ফিরদৌসি। নাজিমুদ্দিন ভূঁইয়া পরে নাম ধারণ করেন প্রফেসর নাজিম পাশা।
জাদুশিল্পী প্রফেসর নাজিম পাশার ম্যাজিকনির্ভর সংসার আর বিভ্রমমাখা জীবন পরিক্রমায় আবর্তিত এ উপন্যাসের কাহিনী। নাজিম পাশার সাফল্য-ব্যর্থতার বিরাট ইতিহাস আঁকা আছে এখানে। আছে রূপকথা-লোককথাভিত্তিক গীতিকা-যাত্রা-সার্কাস-ম্যাজিককে আশ্রয় করে জীবিকা নির্বাহকারী সংগ্রামী শিল্পলগ্ন মানুষের জীবনবাস্তবতার ছবি।
হাজার হাজার মানুষের মন জয় করা যার পেশা ও একমাত্র সাধনা সেই নাজিম পাশা কিনা জয় করতে পারেনি তার কন্যা- ম্যাজিক দলের অন্যতম আর্টিস্ট চম্পার মন। পাশার ছকবাঁধা অনগ্রসর সংসারযাত্রায় বীতশ্রদ্ধ কন্যা চম্পা। সে খাঁচায় আটকে-পড়া পাখির মতো ছটফট করে প্রতিনিয়ত- নীরবে, সন্তর্পণে। চায় মুক্তি। প্রত্যাশা তার স্বাভাবিক সংসারের।
জহির অবশ্য চম্পাকে বিয়ে করে সংসার উপহার দিতে চায়। কিন্তু, কেন জানি, তাকে চম্পার ভালো লাগেনি কখনও। জহির বারবার প্রকাশ করেছে তার মনোবাসনা, জোরও করেছে মধ্যে মধ্যে; চম্পা বরাবরই দেখিয়েছে অনীহা। এই সংসার-প্রত্যাশী নারী মনের ভাব পরিবর্তন ঘটে দলে নতুন-আসা প্রবল সম্মোহনক্ষমতার অধিকারী আল্লারাখার আবির্ভাবের পর।
প্রফেসর নাজিম পাশার ভগ্নপ্রায় জাদু দলে হঠাৎ এক অভ্যাগতের আবির্ভাব ঘটে। তার নাম আল্লারাখা। তার পিতা-মাতার কোনো সন্তান বাঁচত না, সে-ই প্রথম বেঁচে থাকল বলে এরকম নাম রাখা হয়েছে।
হতে পারে পাশার ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য স্রষ্টাপ্রেরিত কোনো মহামানব সে; কিংবা আপামর মানবজাতির কল্যাণের জন্য আসা কোনো মঙ্গলবার্তাবাহক। যখন পাশার দলের খ্যাতি ও প্রসার স্তিমিত হতে চলেছে, হঠাৎ অসময়ে বৃষ্টির আবির্ভাবকে যখন জনতা নাজিম পাশার জাদুর প্রভাব ভেবে তার ওপর আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে; তার দল ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দায় যখন প্রধান সংকট, তখন আসে, বেহেশতের সুবাতাস হয়ে, এই সুপারম্যান। তার আগমন বার্তা জানাচ্ছেন ঔপন্যাসিক- ‘একসঙ্গে চমকে মুখ ফিরিয়ে সবাই দেখে, বারান্দার নিচে তাদের পেছনে একটা মানুষ গাছের মতো দাঁড়িয়ে ভিজছে অন্ধকারে। নড়ছে না, শব্দ করছে না।
বৃষ্টি আর অন্ধকারে ভালো করে ঠাহরও হচ্ছে না সত্যি সত্যি মানুষ, না আর কিছু।’ আগন্তুকের জাদুবলে বেঁচে গেল নাজিম পাশা, ঘুরে দাঁড়াল তার দল। ম্যাজিক করে সে বানাতে লাগল রক্তের মতো টকটকে সব গোলাপ। ‘হঠাৎ লোকটা যেন খ্যাপা হয়ে গেল। পাগলের মতো যেখানে হাত দিল সেখান থেকেই বেরোল গোলাপ। সে ছুড়ে দিতে লাগল গোলাপ জনতার মধ্যে।
একশ, দুইশ, তিনশ, শত শত। তার আর শেষ নেই। শো-ফেরত লোকেরা বলাবলি করছিল ম্যাজিশিয়ান দশ হাজার গোলাপ তৈরি করেছে। প্রকৃত অর্থে সে বানিয়েছে সাতশ’ ছিয়াশিটা গোলাপ। ৭৮৬ অর্থাৎ ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ অর্থাৎ ‘আরম্ভ করছি পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে।’ মানুষ যখন বিপদগ্রস্ত হয়, তখন ভরসা থাকে কেবল সৃষ্টিকর্তার ওপর।
তার ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখলে যে কোনো মহাসংকট থেকেও পাওয়া যায় অনায়াস-নিস্তার। তবে এরও রয়েছে নিশ্চিত কোনো সীমারেখা। সবার প্রার্থনা কিংবা সবসময়ের প্রার্থনা মহাশক্তিমান আল্লাহ কবুল নাও করতে পারেন। কিন্তু এর জন্য রয়েছে ধৈর্য ধারণ করার নির্দেশনা। নিশ্চয়ই তিনি ধৈর্য ধারণকারীকে পছন্দ করেন।
জান্নাতের সঙ্গে মিল রেখে নাজিম পাশা অল্লারাখার নাম রাখেন ফিরদৌসি। জান্নাতের ফুলের সৌরভ আর জাদুকর ফিরদৌসির রক্তগোলাপ সৃষ্টি ও বিতরণের বিষয়টিকে নাজিম পাশা ব্যাখ্যা করেন এভাবে- ‘সাত আসমান আর দো-জাহানের লাখো কুদরতের এক কুদরত রক্তগোলাপ- একটানা উচ্চকণ্ঠে আবৃত্তি করে যেতে লাগলেন প্রফেসর নাজিম পাশা- সারা দুনিয়ার বড় বড় জাদুকর, বড় বড় ম্যাজিশিয়ান, বড় বড় কুদরতি কামেল পর্যন্ত এ খেলার সন্ধান জানে না।
শত শত বৎসরে একজন- মাত্র একজনকে এই অদ্ভুত মায়া শক্তি দেয়া হয়। ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য রক্তগোলাপ। বাগান লাগে না- গাছ হয়; পানি লাগে না- বড় হয়; দুনিয়ার সাত ভেজালে বাঁধা চোখ দিয়ে সে ফুল দেখা যায় না। সেই ফুল, সেই রক্তগোলাপ দেখালেন আজ আমার প্রিয় সাগরেদ ফিরদৌসি।’
সৈয়দ শামসুল হক অদ্ভুত এক মায়ালাগা, ঘোরলাগা পরিবেশ-বর্ণনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছেন ইহকাল-পরকালবিষয়ক ভাবনারাজি, জাগতিক মোহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পাপ-পুণ্যবোধ আর স্রষ্টাপ্রেরিত মহামানবের বাণী ও আনুকূল্য; জগত থেকে অনাচার-পাপাচার মুছে দিয়ে মানবমুক্তির প্রসন্ন প্রতিবেশ নির্মাণ করতে চান তিনি।
আর মুক্তিপ্রয়াসী চম্পাকে প্রদান করেন ফিরদৌসির সান্নিধ্য-পক্ষান্তরে বেহেশতের খুশবু মাখা আবহ; আল্লারাখাও এগিয়ে যেতে থাকে কল্যাণের-শুভবোধের মহাসড়ক ধরে, নীরবে, ধীরে, একা- ‘বালিশে মৃদু সুবাস। অনেক রাত ধরে পরতে পরতে জমেছে, জড়িয়ে গেছে। দু-একটা দীর্ঘ চুল লেগে আছে এখনও। আল্লারাখার ঘুমন্ত গালের নিচের সেই চ্যুত চুলগুলো শিরশির করে নদীর মতো সচল হয়ে উঠছে।’
আপাতভাবে ফিরদৌসি আর চম্পার মিলন- নির্জন রাতে স্কুলঘরে একত্র যাপনকে জাগতিক প্রেম বলে আমরা বিভ্রমে পড়তে পারি। কিন্তু, প্রকৃত অর্থে, এ হল ইহজাগতিক মানবের পারলৌকিক স্বাচ্ছন্দ্যের-আনন্দের প্রাপ্তি-আভাস-চিত্র। ঔপন্যাসিক এ বাস্তবতাকে নির্দেশ করেছেন এক অনাস্বাদিত মিশ্র-অনুভূতি হিসেবে। তার ভাষ্য- ‘চোখে চোখে তাকিয়ে রইল দু’জনে।
নাগর-দোলার মতো তাদের চোখ থেকে চোখে উঠতে পড়তে লাগল আনন্দ, বিষাদ, বাস্তব, বিভ্রম।’ চম্পা শেষত পালাতে চায়। তার এই পলায়ন-প্রবণতা কি জীবন থেকে মুক্তির নেশা, না-কী অন্য এক নিশ্চিত জীবনের অন্বেষা? শেষ পর্যন্ত কি সে সেই মুক্তির অনুভবস্পর্শ পেয়েছে, নাকি জহিরের সঙ্গে বাঁধতে হয়েছে অনিচ্ছুক সংসার? – এসব প্রশ্নের মীমাংসা মেলে না। সৃষ্টিরহস্য কি এরকম নয়- কিছু জানা, কিছু অজানা? আসলে জানতে পারি আমরা সামান্যই, বেশিরভাগটাই রয়ে যায় অবোধ্য-অনুদ্ঘাটিত। তাই যতটুকু সম্ভব আত্মবিশ্বাস আর আনন্দ-অনুভবের শক্তি সঞ্চয় করাটা খুব জরুরি- এ মেসেজ আছে সৈয়দ শামসুল হকের বর্তমান বিবেচ্য উপন্যাস রক্তগোলাপে।